দিনের আঁধার

রাত (মে ২০১৪)

মোঃ আক্তারুজ্জামান
মোট ভোট ১২ প্রাপ্ত পয়েন্ট ৪.৪১
  • ১৬
  • ১০
(১)
অন্ধকারে অনির সবসময়ই বড় ভয়। তাই যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে থাকে তখন অনি যেন ফুরিয়ে যেতে থাকে। এঘর থেকে ওঘরে যেতেও ওর সাথে একজন মানুষ থাকা লাগে। অনি থাকে সামনে। পিছনে থাকলে ওর মনে হয় অদৃশ্য কিছু একটা তাকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে অন্ধকারে হারিয়ে যাবে।

ছোটবেলা সবারই কম বেশি একটু আধটু ভয় থাকে বয়স বাড়ার সাথে সাথে ওসব কমেও যায়। কিন্তু অনির বেলায় তা কমল না। এই একটা ব্যাপারে সে শিশুর মতোই ভীতু রয়ে গেল। দিনের বেলায় বাড়ির আঙিনার আশে পাশের যে আম গাছটা জাম গাছটার মগ ডাল বেয়ে বেড়ায়। রাতের বেলায় সে ওসব গাছের তলায় পা মাড়ানোতো দুরের কথা তাকিয়েও দেখে না। দিনে সে যে ডালটায় চড়ে বসে আনন্দে চিৎকার চেঁচামেচি করে হাত পা ছোঁড়াছুড়ি করে রাতে সেই ডালটার জমাট অন্ধকার যেন তার ভয়ানক শত্র“। তাই তার ওটার দিকে তাকানোর সাহস হয় না।

অন্ধকার বারান্দা থেকে প্রায় লাফিয়ে আলো জ্বালিয়ে রাখা ঘরে ঢুকে যেতে পারলে সে যেন বড্ড বাঁচা বেঁচে যায়। অন্ধকার তার কাছে নরকের মত মনে হয়। অন্ধকারের গায়ে লুকিয়ে থাকা হাজারটা অশীরীরি চোখ যেন বিস্ফারিতভাবে তার দিকেই সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকে, হাজারটা হাত যেন তাকেই তুলে নেয়ার জন্য সবসময় আগ বাড়িয়ে আছে।

মা এমন ভীতুর ডিম মেয়ে সামলাতে সামলাতে মহা বিরক্ত। বাবাও ওর ভয় পাওয়া দেখে ঘাবড়ে যান। এই মেয়ে কবে না অকারণ ভয় পেয়ে মরে যায় সেই ভয়ে নিজেও মেয়েকে বোকার হদ্দ বলে ধমকান। অথচ অনি খুব মেধাবী ছাত্রী। ক্লাস নাইনে ভর্তির সময় স্কুলের হেড স্যারই বিজ্ঞান বিভাগে নামটা তুলে দিলেন। এমন মেধাবীরা নাকি বিজ্ঞানী না হলেও ভাল ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবে!

অনি ক্লাসের সেরাদের সেরা থেকেই এসএসসিটা শেষ করল। কলেজে ভর্তি হতে গিয়ে বাবা মায়ের সাথে জীবনে প্রথম কোন কিছু নিয়ে সে দ্বিমত পোষণ করল। অনি বলল ভাল ফল করার জন্য সে ঢাকার কোন নামী দামী কলেজে ভর্তি হবে। বাবা বলল তা হবে না ভর্তি হতে হবে তাঁদের সদরের কলেজেই। উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে তারপর যেখানে খুশি ভর্তি হবে।

অনি নিজেও জানে সে যেখানেই ভর্তি হোক না কেন তাতে তার কোন সমস্যা নেই। আসলে সে পালাতে চেয়েছিল। গ্রামে বড় বেশি বাড়াবাড়ি রকমের অন্ধকার তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই সে আসলে আলো ঝলমলে শহরে ঠাঁই নিতে চেয়েছিল। কিন্তু মিথ্যা অজুহাতে সে বাবা মায়ের অবাধ্য হতে পারল না। জেলা সদরের সরকারি কলেজেই ভর্তি হয়ে লেখাপড়ায় মন দিল।

ওদের বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে একই গ্রামে ওর ছোট কাকার বাড়ি। অনি সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পরই ওর কাকার পাকস্থলীতে ক্যান্সার ধরা পড়ল। ওর বাবা মা যখন তখন ওবাড়িতে ছুটাছুটি করেন। সময়ে অসময়ে বাড়াবাড়ির খবর আসে। দিনে হলে কোন সমস্যা হয় না। কিন্তু রাতে সমস্যা হয়। বাবা মা ওকে বাড়িতে রেখেও যেতে পারেন না, নিয়েও যেতে পারেন না।

একদিন দুপুরের পর খবর এলো ওর ছোট কাকার অবস্থা খুবই খারাপ। বাবার চেহারা থমথমে অন্ধকার হয়ে গেল। মা বার কয়েক আল্লাকে ডাকলেন। এমন দিন কয়েক পর পরই হয়। যখন তখন করেও মানুষটা টিকে আছে। অনির মা ওকে বললেন- যাবি নাকি?

অনির এসব ভাল লাগে না। কাকার এত কষ্ট ওর সহ্য হয় না। অনি মাকে বলল- না, আমার ভাল লাগে না। আমি থাকি। আজ তোমরাই যাও।

মেয়ের মনের অবস্থা বুঝে মা বললেন- তবে তুই থাক আমি কিছুক্ষণ পরেই চলে আসব।

কিছুক্ষণের কথা বলে গেলেও সন্ধ্যা নাগাদ বাবা মা কারও ফেরার কোনই নাম নিশানা অনি দেখতে পেল না। তখন সে চূড়ান্ত বিপদের কথা আন্দাজ করল। তার মনে হত লাগল তার ছোট কাকা হয়ত এবার সত্যি সত্যি মারা গেছে।

ক্রমেই তার মাঝে অস্থিরতা বাড়তে লাগল। সাত পাঁচ ভেবে সে ঘরের দরজায় যখন তালা মেরে দিল তখন সূর্য ডুবে গেছে তার উপর একটুকরা মেঘ হঠাৎ করেই যেন থাবা মেরে দিনটাকে নিঃশেষ করে দিয়েছে।

আলো আঁধারিতে অনি বাতাসের বেগে ছুটল। গ্রামের মাঝখান দিয়ে একটা গোপাট। এই পথে বহুকাল ধরে গ্রামের সবার গরু গ্রামের বাইরে আনা নেয়া করা হয়। গরুর চলা ফেরায় ওটা হয়ে উঠেছে খালের মত গভীর। অনি তার মাঝখান দিয়েই ছুটে চলল।

গোপাটের শেষ মাথাটায় বিশাল একটা জলপাই গাছ। ওটার নীচে এসেই অনিন্দনীয়ার শরীরের গায়ের সবগুলি লোম কাঁটা দিয়ে উঠল। মাথার চুলগুলি এক একটা যেন খেঁজুর কাঁটার মত খাঁড়া হয়ে উঠল। ভয়ে শরীরের মাংসপেশীর অতিরিক্ত সংকোচনের ফলে তার কপালের চামড়ায় টান পড়ে তা যেন চড়্ চড়্ করে উঠল। এই গাছটার নীচ দিয়ে দিনের বেলায়ই একা একা আসা যাওয়া করতে কেমন গা ছম্ ছম্ করে।

নিজের পায়ের পাতার দুপ্ দাপ্ শব্দ স্তব্দতা ভেঙ্গে যতই প্রতিধ্বনিত হতে লাগল বুকে হাপড় পড়ার শব্দও তার ততই বাড়তে লাগল। বাতাসে মিহি দানার মত বৃষ্টি ঝরতে শুরু করেছে অনির সেদিকে কোন খেয়ালই নেই। বৃষ্টির পানি চুল, গাল বেয়ে পড়তে পড়তে অস্বস্তি আর ভয়ের মাত্রাকে যেন আরও উসকে দিতে লাগল।

জলপাই গাছটা পার হয়ে একটু খোলা আকাশ তার সামনেই একটা কচু ক্ষেত। অনি স্পষ্ট দেখতে পেল গোলাকার মত একটা কিছু সমানে ডানে বামে করে মাথা দোলানোর মত করে দুলছে। সামনে বড় একটা বকুল গাছে আর কাছাকাছি একটা গাবগাছের ছায়ায় জমাট বাঁধা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে অনির পা দুটো যেন মাটিতে গেঁথে গেল।

অন্ধকার ভেদ করে সামনের দিক থেকে একটা অবগুন্ঠিতা ছায়ামূর্তি ক্রমেই তার দিকে আসতে দেখে তার মুখ হা হয়ে গেল। মুর্তিটা ক্রমেই নিকটবর্তী হতে দেখে সে একবার মাত্র অস্ফুট স্বরে মা ডাকার চেষ্টা করেই মাটিতে ঢলে পড়ল।

অনির কাকা মারা গেছে। নানা ঝামেলা সামাল দিয়ে তার মায়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হতে হতেই চারিদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে তাই তিনি মেয়ের ভয় পাওয়ার কথা ভেবে ছুটছিলেন। বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য মাথায় আঁচলটা টেনে দিয়েছিলেন একটু লম্বা করে। কিন্তু তাকে দেখেই মেয়ে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যাবে জীবনেও ভাবেন নি।


(২)
অনি সারা শরীরে পানি ঢালছে বালতির বালতি পানি। সন্ধ্যার পরে কোন মতে নিজের রুমে ঢুকে দরজাটা আটকে দিয়েই সে টলতে টলতে গোসলখানায় পা দিয়েছে। তারপর থেকে বিরামহীনভাবে পাগলের মত পানি ঢালছে সে। সাবান শ্যাম্পুর ফেনা পানির সাথে পাল্লা দিয়ে নেমে কুলোতে পারছে না।

ঢাকা মেডিকেল কলেজে অনির ইন্টার্ণি করা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। মাস তিনেক হয় সে ফার্মগেইটে একটা ক্লিনিকে খন্ডকালীন কাজ নিয়েছে। কাজের সুবিধার জন্য ইন্দিরা রোডের একটা কর্মজীবি মহিলা হোষ্টেলে উঠেছে। রুমে আরও দু’জন মেয়ে আছে, ওরা লেখাপড়া করে। প্রতি বৃহষ্পতিবার ওরা নিজেদের বাড়ি চলে যায়।

তিন দিন আগে অনি শুক্রবার সকালবেলা তিনতলার সিঁড়ি বেয়ে বেশ ফুরফুরে মেজাজেই বাসাটা থেকে রাস্তায় নেমেছিল। তেজগাঁও কলেজের গেইটের একটু সামনে একটা পুরান সাদা টয়োটা গাড়ি দাঁড়িয়েছিল ওটা আসলে তার নজরেই পড়ে নি। পড়ার কথাও না। ঢাকা শহরে কত গাড়ি চলে কোনটা কোথায় থামে কোথায় যায় তা পথচারী হিসেবে কে খেয়াল রাখে?

গাড়িটার পাশ দিয়েই যাচ্ছিল অনি। সিনেমার মত একটা দূর্দান্ত অকল্পনীয় ঘটনা ঘটে গেল। একজন গাড়িটার পিছনের একটা দরজা চট্ করে খুলে দিল। আর দু’জন খপ্ করে অনিকে ধরে কিছু না বুঝে উঠার আগেই গাড়িতে তুলে নিল। বুঝে উঠতে বেশি সময় লাগে নি। কিন্তু ততক্ষণে গাড়িটা চলতে শুরু করেছে। দুপাশ থেকে দুজন অনিকে নির্বাক করে ফেলেছে।

রাত প্রায় ফুরিয়ে আসছে তবু অনির শরীরে পানি ঢালা শেষ হচ্ছে না। তার শরীর থেকে এক রত্তি প্যাঁকও যেন সে সরাতে পারছে না। শরীরের সব কাপড় চোপড় খুলে ফেলে সে নিজের শরীরের এখানে ওখানে সবখানে পাগলের মত সাবান ঘষে, হাত বুলিয়ে আপ্রাণ চেষ্টায়ও যেন নিজেকে একটু সাফ সুতরো করতে পারছে না।

কখন জানি লাইটটি কেটে গিয়ে গোসলখানাটা একটা কবরের মত হয়ে উঠেছে। তবু তার আজ এক বিন্দুও ভয় লাগছে না। দিনের আঁধারে রাতের ভয় আজ ঢাকা পড়ে গেছে- অনিন্দনীয়ার।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
শামীম খান অভিভূত হলাম । শুভ কামনা ।
ওয়াহিদ মামুন লাভলু অনেক অভিনন্দন ও শ্রদ্ধা জানবেন।
আখতারুজ্জামান সোহাগ গল্পটা পড়ে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকলাম। প্রচণ্ড একটা ধাক্কা মেয়েটির সব ভয়কে দূরে ঠেলে দিল, যদিও ধাক্কাটা ভীষণ অনাকাঙ্ক্ষিত। এমন ধাক্কা করো জীবনে না আসুক। শুভকামনা।
আলমগীর সরকার লিটন হু দাদা খুবি ভাল লাগল গল্পটা শুভ কামনা রইল
Gazi Nishad শুধুই অসাধারণ। আমন্ত্রণ রইলো আমার পাতায়।
সূর্য অন্ধকার সে সব সময়ই ভয়ের হোক তা আলোর অভাবে অথবা বিবেকের অভাবে। আলোর অন্ধকার হয়তো দূর করা যায় অথচ অনিন্দনীয়ার জীবন যে আঁধারে নিক্ষিপ্ত হলো সে আঁধার দূরীভুত করার কোন আলো কি এখনো আবিস্কৃত হয়েছে? আপনার গল্পের দুটো অধ্যায়ে অন্ধকারের দুটো রূপই অত্যন্ত দৃঢ়তায় ফুটেছে। যদিও ২য় অধ্যায়ে একটু তাড়াহুড়ো লক্ষণীয়। বরাবরের মতো অসাধারণ লিখেছেন প্রিয় শিল্পী...
মিলন বনিক দাদা..চমৎকার অনুগল্প...টান টান উত্তেজনায় বার বার মনে আসছিল পরের লাইন কি হবে....গল্পই যেন খুব সহজে গল্পের ভিতর টেনে নিয়ে গেলো,,,অসাধারন,....
ওয়াহিদ মামুন লাভলু অন্ধকার ভীতি, শিক্ষণীয় কঠিন বাস্তব চিত্র, চিন্তার খোরাকযুক্ত শিরোনাম সব মিলিয়ে চমৎকার একটি লেখা। খুব ভাল লাগল। শ্রদ্ধা জানবেন।
বশির আহমেদ অন্ধকারকে ভয় পাওয়া মানব মনের চির কালীন একটা সত্য তার সাথে আমাদের সমাজ জীবনের অন্ধকার জগতকে এমন সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন যা আপনার ভাবনার জগত সম্পর্কে পাঠককে আরও সমৃদ্ধ করবে বলেই াামার বিশ্বাস । অনিন্দনীয়া নামটার মাঝেও অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে বলে আমার ধার না ।

২২ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৩২ টি

সমন্বিত স্কোর

৪.৪১

বিচারক স্কোরঃ ২.৬১ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ১.৮ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪